ফিরে দেখা ২০২৪
আলোচনায় হত্যাকাণ্ডের ৭ ঘটনা, পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ
স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় :
৩০-১২-২০২৪ ০৮:৫৬:০০ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
৩১-১২-২০২৪ ১০:৪১:২০ পূর্বাহ্ন
ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান। ফাইল ছবি
বিদায়ী ২০২৪ সালে দেশ-বিদেশে আলোচিত ৭টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনার জন্ম দিয়েছে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থাণে নিহতদের ঘটনা। সে আন্দোলনের ফলে আবু সাঈদ ও মীর মুগ্ধসহ ৬৭৩ জনের অধিক নিহত হয়েছেন। আর আহত হয়েছেন শিক্ষার্থীসহ প্রায় ২১ হাজার আন্দোলনকারী।
অপর ঘটনাগুলো হচ্ছে, চাঁদপুরের মেঘনায় জাহাজে সাত খুন, বিশ্ব ইজতেমার মাঠে দু’পক্ষের সংঘর্ষে ৪ জনের মৃত্যু, পাহাড়ি ও বাঙালি সংঘর্ষে ৪ জন নিহত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনি দিয়ে তোফাজ্জল হোসেনকে হত্যা, চট্টগ্রামে ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে আইনজীবী সাইফুল হত্যা ও এমপি আনোয়ারুল আজিম নিখোঁজ ঘটনা।
এর মধ্যে এমপি আনোয়ারুল আজিম নিখোঁজ ও ভারতে নিহতের ঘটনা সাবেক সরকারের আমলে হলেও বাকি হত্যার ৬টি ঘটনা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের আগে-পরের। এসব ঘটনার কোনো কোনোটিতে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সম্পৃক্ততা নিয়েও সমালোচনা ছিল। যার পরিনতিতে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে সারাদেশে থানা আক্রমণসহ পুলিশ সদস্য হত্যার মত নৃশংস ঘটনাও ঘটেছে। এসব ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর মানুষের আস্থা হারানোর প্রামান্য বিষয়।
এমপি আনোয়ারুল আজিম নিখোঁজ
চলতি বছরের ২২ মে ভারতের কলকাতায় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমের লাশ উদ্ধার হয়। ভারতে চিকিৎসার উদ্দ্যেশে গিয়ে তিনি ১৩ মে থেকে নিখোঁজ ছিলেন। এই ঘটনায় ৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০ মে পর্যন্ত তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ২২ মে সকালে কলকাতার নিউটাউনে অভিজাত আবাসন সঞ্জীবা গার্ডেন থেকে তার শরীরের কিছু অংশ উদ্ধার হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, ১৩ মে নিউটাউনের সেই বাড়িটিতেই তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলন
কোটা সংস্কার আন্দোলন বা জুলাই আগস্ট আন্দোলন অথবা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ২০২৪ সালে বাংলাদেশের সবথেকে বেশি আলোচিত বিষয়। ২০২৪ সালের ৫ জুন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের জারি করা পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণার পর কোটা পদ্ধতির সংস্কার আন্দোলন আবার নতুনভাবে আলোচনায় আসে। শুরুতে আন্দোলন সভা-সমাবেশের মধ্যে স্থির থাকলেও ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর এক বক্তব্যে কোটা আন্দোলনকারীদের পরোক্ষভাবে ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ হিসেবে অভিহিত করেন। এরপর থেকেই কোটা আন্দোলন আরও জোরদার হয়। এই আন্দোলনে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারী (প্রায় ২১ হাজার) আহত হওয়ার পাশাপাশি আবু সাঈদ ও মীর মুগ্ধসহ ৬৭৩ জনের অধিক নিহত হন।
পরিশেষে ২১ জুলাই বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করে এবং সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করে। ২২ জুলাই এই বিষয়ে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে।
ঢাবিতে গণপিটুনি দিয়ে তোফাজ্জল হোসেন হত্যা
ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালে ছয়টি মোবাইল চুরির অভিযোগ এনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তোফাজ্জল হোসেনকে আটক করে। তাকে ফজলুল হক মুসলিম হলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর যেখানে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। ছাত্রলীগের তিনজন নেতা এবং দুই সক্রিয় সদস্যসহ ছাত্ররা তাকে ক্রিকেট ব্যাট ও স্ট্যাম্প ব্যবহার করে আহত করে। কিছুক্ষণ পর তোফাজ্জলকে হলের ক্যানটিন থেকে খাবার সরবরাহ করা হয়, কিন্তু তার খাওয়া শেষ করার পরপরই এক্সটেনশন বিল্ডিংয়ের গেস্টরুমে নিয়ে সহিংসতা চালানো হয়। শিক্ষার্থীরা হোসেনের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকা দাবি করে। একটি প্রক্টর দল ঘটনাস্থলে পৌঁছালেও হোসেনের তাৎক্ষণিক মুক্তি নিশ্চিত করতে পারেনি। হোসেনের অবস্থার অবনতি হলে তাকে প্রক্টরদের কাছে হস্তান্তর করা হয়, যারা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে পৌঁছালে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে নিহত ৪, আহত ৭০
২০২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ভোরে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা সদর এলাকায় মামুন নামে এক ব্যক্তি মোটরসাইকেল চুরি করে পালাতে গিয়ে বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে ধাক্কা লেগে গুরুতর আহত হন। এ সময় স্থানীয় জনতা তাকে গণধোলাই দেয়। পরে মামুনকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দীঘিনালা সরকারি কলেজের ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল করে। আর কিছু বিক্ষুব্ধ পাহাড়িদের দোকানপাটে হামলার চেষ্টা করে। যা পরবর্তীতে সাম্প্রদায়িক হামলায় রূপ নেয়। এতে অর্ধশতাধিক পাহাড়িদের দোকান ও বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
১৯ সেপ্টেম্বর রাতের এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরদিন ২০ সেপ্টেম্বর রাঙামাটিতেও পাহাড়ি-বাঙালি দু’গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এতে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে ৪ জন প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্যে খাগড়াছড়িতে তিনজন নিহত ও ২০ জন আহত এবং রাঙামাটিতে একজন নিহত ও ৫০ জন আহত হয়েছেন। একপর্যায়ে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে ১৪৪ ধারা জারি করতে বাধ্য হয় প্রশাসন।
ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ প্রসঙ্গ এবং আইনজীবী সাইফুল হত্যা
২০২৪ সালের ২৫ নভেম্বরে ইসকন নেতা চিন্ময়কে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ঢাকা বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করে। জাতীয় পতাকার উপরে গেরুয়া পতাকা উত্তোলনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়। পরদিন ২৬ নভেম্বর তাকে চট্টগ্রাম ষষ্ঠ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়, যেখানে ম্যাজিস্ট্রেট কাজী শরিফুল ইসলাম তার জামিন আবেদন নাকচ করে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেন। এদিন চট্টগ্রামে চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ-এর রিমান্ড শুনানিকে কেন্দ্র করে তার সমর্থকেরা আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে কুপিয়ে হত্যা করে।
বিশ্ব ইজতেমার মাঠে সংঘর্ষ, ৪ জনের মৃত্যু
২০২৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দান দখল নিতে তাবলিগ জামাতের দু’পক্ষের (মাওলানা সাদ কান্ধলভি ও মাওলানা জুবায়ের আহমেদ) অনুসারীদের সংঘর্ষে চারজনের নিহত এবং শতাধিক আহত হয়েছেন।
ঘটনার পরদিন গত ১৯ ডিসেম্বর দুপুর পর্যন্ত টঙ্গী ও আশপাশ এলাকায় সাদ ও জুবায়েরপন্থিরা অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। এ সময় পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। জুবায়েরপন্থিরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক দুই ঘণ্টা অবরোধ করেন। এতে বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। পরে উভয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ইজতেমা ময়দান খালি করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। এদিন দুপুরের পর সবাইকে সরিয়ে দিয়ে মাঠের নিয়ন্ত্রণ নেন সেনা, পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি সদস্যরা। এ ছাড়া পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত ইজতেমা ময়দান ও আশপাশ এলাকায় সভা-সমাবেশ, মিছিল ও বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করেছে পুলিশ।
চাঁদপুরের মেঘনায় জাহাজে সাত খুন
২০২৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর চাঁদপুরের হাইমচরের ঈশানবালা খালের মুখ (মেঘনা নদীত) এলাকায় এম ভি আলু বাখেরা নামের একটি সারবাহী জাহাজ থেকে সাতজনের রক্তাক্ত দেহ উদ্ধার করে নৌ পুলিশ।
তাৎক্ষণিক পাঁচজনকে পাওয়া যায় মৃত অবস্থায়। দুজনকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন। এর বাইরে গুরুতর আহত একজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। বর্তমানে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
সাত খুনের এই ঘটনায় আলোচনার জন্ম দেয় দেশজুড়ে। সমালোচনার মুখে পড়েন অন্তর্বর্তী সরকার। যদিও ঘটনার পরদিন গত ২৪ ডিসেম্বর রাতে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা, র্যাব-১১ ও ৬-এর যৌথ অভিযানে বাগেরহাটের চিতলমারী এলাকায় থেকে জড়িত সংশ্লিষ্ট জাহাজের লস্কর আকাশ মন্ডল ওরফে ইরফানকে (২৬) গ্রেপ্তার করে।
দেশজুড়ে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ৭টি ঘটনার মধ্যে ৬টিতে পুলিশের সম্পৃক্ততা না থাকলেও জুলাই-আগস্টের এক আন্দোলনেই ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালানোয় বাহিনীটির ভাবমূর্তি হয় প্রশ্নবিদ্ধ।
বাংলা স্কুপ/এএইচ/এসকে
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স